উজ্জল মেহেদি, সিনিয়র রিপোর্টার, সংবাদ২৪
ঢাকা: আইসিটি বিভাগের ইনোভেশন ডিজাইন এন্ড অন্টারপ্রেনারশিপ একামেডি (আইডিয়া) প্রকল্পের টেকনিশিয়ান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত মোমিনুল ইসলাম স্টার্টআপ ইকো-সিস্টেম নিয়ে কোনোদিন কাজের নূন্যতম অভিজ্ঞতা না থাকলেও আওয়ামী সরকারের সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের অদৃশ্য ইশারায় অবৈধ উপায়ে হয়েছেন স্টার্টআপ কনসালটেন্ট। ২০১৭ সাল থেকে পুরো আইডিয়া প্রকল্পকে প্রভাব খাটিয়ে কব্জা করে রেখেছেন তিনি। অনুদানবাণিজ্য ও টেন্ডার বাণিজ্যের বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ ওঠেছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে আইডিয়া প্রকল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে সবাইকে কোনঠাসা করে রাখছিলেন মোমিনুল ইসলাম। তার ধাপটের কাছে ক্যাডার অফিসাররাও অসহায় ছিলেন। নিজের ইচ্ছেমতো প্রকল্প ও টেন্ডার বানিয়ে প্রকল্প পরিচালককে দিয়ে সাক্ষর করে তার আত্মীয়স্বজনদের কাজ দিতেন তিনি। প্রয়োজন ছাড়া বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে গত ৬ বছরে তিনি শত শত টেন্ডার করে নিজেদের ঘনিষ্ঠদের দিয়েছেন মোমিন। আইসিটি ডিভিশনের প্রয়োজন দেখিয়ে প্রাইভেট সার্ভার নিয়ে অবৈধ ইন্টারনেট মাইনিং এর মতো কাজ করেন বলেও অভিযোগ করেছেন তার সহকর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইডিয়াকে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা জানান, মোমিন একজন ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার। পড়াশোনা শেষে প্রাইভেট কোম্পানিতে সিস্টেম সাপোর্টি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। আইডিয়া প্রকল্পে তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশে জুনাইদ আহমদ পলক এর মাধ্যমে সিস্টেম সাপোর্ট কাম টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিমন্ত্রীর আর্শিবাদে কোনো ধরণের যোগ্যতা পূরণ না করেই কনসালটেন্ট হিসেবে পদোন্নতি নেন। নিয়ম অনুযায়ী আইডিয়া প্রকল্পে কনসালটেন্ট হতে হলে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম নিয়ে দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতা ও একাডেমিক উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন। কিন্তু মোমিনের তার কোনো যোগ্যতা না থাকা পরও তিনি কনসালটেন্ট হয়েছে।
জানা যায়, কনসালটেন্ট হওয়ার আগে থেকেই আইডিয়ার সাবেক প্রকল্প পরিচালক আসতাফ হোসেন এর যোগসাজসে মোমিন ১০ লাখ টাকা অনুদান পাইয়ে দেয়ার নামে বিভিন্ন স্টার্টআপ এর কাছে থেকে ৩০% কমিশন গ্রহণ করেন। অভিযোগ রয়েছে আইডিয়া থেকে যেসব স্টার্টআপকে অনুদান দেয়া হয়েছে তাদের অর্ধেকেরই কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০২৩ সালে বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ট নামক স্টার্টআপ প্রতিযোগিতায় আইসিটি বিভাগের যুগ্নসচিব মোস্তাফিজুর রহমানের সাথে মিলে বিশাল দুর্নীতি করেন মোমিন। প্রতিযোগিতায় সেরা ৫০ টি স্টার্টআপ এর তালিকায় বিজয়ী হয়ে ১০ লাখ টাকা অনুদান পাইয়ে দেয়ার জন্য অনেকের থেকে ৩০-৫০ শতাংশ করে টাকা নেন মোমিন ও মোস্তাফিজুর।
এছাড়া কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, ডিভাইস ক্রয়, বিভিন্ন মেরামত এর নামে টেন্ডার করে তার নিজের মামাতো ও খালাতো ভাইদের কাজ দিতেন মোমিন। তাদের নামে কাজ নিলেও মূলত সাপ্লাইয়ের কাজ তিনি নিজেই করতেন। এছাড়াও পলকের ঘনিষ্ট সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে রমরমা প্রকল্প বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। আইডিয়া থেকে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের কাজ বের করে দিতেন এবং এর বিনিময়ে মোটা অংকের টাকার ভাগভাটোয়ারা করতেন মোমিন।
মোমিনুল ইসলামের সাবেক এক সহকর্মী জানান, অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা দিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং সোসাইটিতে নিজের স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে ৮৬ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি ফ্লাট কিনেছেন মোমিন, এছাড়া রাজশাহীর কলেজ রোডে খালাতো ভাইয়ের সাথে মিলে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। এছাড়া বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ক্রিপটোকারেন্সি বিটকয়েনে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে বলেও জানা গেছে।
এছাড়াও আওয়ামী সরকারের আমলে তিনি নিজেকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে ধাপট দেখাতেন। অনুদান পাইয়ে দিতে কমিশনের চুক্তিতে কেউ আগ্রহী না হলে গ্রহণযোগ্য স্টার্টআপের ফাইল পিএমসি থেকে সরিয়ে দিতেন। তার অনিয়ম নিয়ে প্রতিবাদ করলে জামাত-শিবির আখ্যা দিয়ে অনেকের কন্ঠরোধ করে রাখতেন।
আইডিয়া প্রোটফোলিও একাধিক স্টার্টআপ ফাউন্ডার, যারা আইডিয়া প্রকল্পের কো-ওয়ার্কি স্পেস ব্যবহার করেন তারা জানান, স্টার্টআপ ফাউন্ডারদের বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করার কাজে যুক্ত থাকলেও তিনি সবসময় ছিলেন নিজের আখের গোছানোর কাজে। দীর্ঘদিন ধরে কো-ওয়ার্কি স্পেসের ওয়াইফাই কানেকশনে সমস্যা থাকলেও সেটি সমাধান কিংবা নতুন ডিভাইসের টেন্ডার না করে একাধিক কম্পিউটার ও মনিটর থাকার পরও তিনি কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ কেনার নামে টেন্ডারসহ নিজের সার্থসংশ্লিষ্ট কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে তিনি সবসময় স্টার্টআপ ফাউন্ডারদের কো-ওয়ার্কি থেকে বের করে দেয়ার ভয় দেখাতেন। প্রতিবাদ করায় অনেককে কোনো কারণ ছাড়া-জামাত শিবির তকমা দিয়ে আইডিয়া ছাড়া করতেন।
আইসিটি ডিভিশনে কো-ওয়ার্কিং স্পেসে কাজ করতেন একটি স্টার্টআপ ফাউন্ডার রাকিব হাসান। তিনি বলেন, মোমিন আইডিয়া প্রকল্পের হর্তাকর্তার ভাব নিয়ে ছিলেন সবসময়। আমি একজন স্টার্টআপ ফাউন্ডার হিসেবে কো-ওয়াকিং স্পেসের জন্য আবেদন করি, প্রকল্প পরিচালক আমার আবেদন গ্রহণ করে বরাদ্ধ দিলেও মোমিনুল সেটি আটকে দেন। একজন ক্যাডার অফিসারের আদেশ অমান্য করার সাহস দেখাতে পারতেন তিনি কেবল মাত্র নিজেকে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের কাছের লোক ও আওয়ামীলীগের পরিচয় দিয়ে। কো-ওয়ার্কি স্পেস বরাদ্ধ দিতেও তিনি বৈষম্য তৈরি করেছেন। প্রত্যেক স্টার্টআপ ৩ টি করে সিট বরাদ্ধ পাওয়ার কথা থাকলেও নিজের ঘনিষ্টদের তিনি তার বেশি জায়গা দিতেন, স্টার্টআপ নয় এমন কোম্পানিকেও তিনি জায়গা দিয়েছেন আইডিয়াতে। তার অনিয়ম নিয়ে কথা বললে মাসুম, রুবেল নামের অধিনস্থ কয়েকজন কর্মচারীকে দিয়ে ফাউন্ডাদের সাথে অসদাচারণ করতেন। আইডিয়া প্রকল্প পুরোটা মোমিনের কাছে জিম্মি। অনেক স্টার্টআপ তার সাথে বিভিন্ন ডিলে রাজি না হওয়ায় বিভিন্ন অজুহাতে তাদের বের করেও দিয়েছেন মোমিন।
বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে মোমিনুল ইসলামের বক্তব্য নেয়ার জন্য একাধিকবার তাকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তার বক্তব্য নেয়ার জন্য আইডিয়াকে গেলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
এদিকে মোমিনুল ইসলামের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন ৪০টিরও বেশি স্টার্টআপ ফাউন্ডার। তারা মোমিনুল ইসলামের পদত্যাগ ও আইডিয়া প্রকল্পকে অনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ার দাবিতে ইতিমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিবের সাথে সাক্ষাৎ করে চিঠি দিয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে আইডিয়া প্রকল্পের পিডি আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা স্টার্টআপ ফাউন্ডারদের অভিযোগ শুনেছি। মোমিনসহ তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।